কোভিড-১৯: ফাইজারের পর এবার মডার্নার ৯৪.৫% কার্যকর টিকার দাবি

18 Nov, 2020
ফাইজারের সিইও অ্যালবার্ট বোরলা। জার্মানির বায়োএনটেকের সঙ্গে মিলে তারা করোনাভাইরাসের টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চালাচ্ছে। চূড়ান্ত ধাপের পরীক্ষায় তাদের টিকা কোভিড-১৯ রোধে ৯০ ভাগ সক্ষম হয়েছে বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ফাইজার।

বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করার মধ্যেই প্রাণঘাতী এই ভাইরাস প্রতিরোধী টিকা নিয়ে সুখবর মিলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কোম্পানি দাবি করেছে, জার্মানির জৈব প্রযুক্তি কোম্পানি বায়োএনটেকের সঙ্গে তারা যে টিকার চূড়ান্ত ধাপের পরীক্ষা চালাচ্ছে, তাতে নতুন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে টিকাটি ৯০ ভাগেরও বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে যেসব টিকার পরীক্ষা চূড়ান্ত ধাপে রয়েছে, তার মধ্যে থেকে ফাইজার-বায়োএনটেকের পক্ষ থেকেই এমন সুখবর মিলল। তবে কোনো টিকার চূড়ান্ত ধাপের পরীক্ষার একেবারেই প্রাথমিক খবর এটি, আর টিকাটি কতটা ভালোভাবে কাজ করবে তাও জানা যায়নি। তাছাড়া আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করে বলা উচিত, সেটি হল- আগামী কয়েক মাসেও এই টিকা বাজারে আসার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং, এত দ্রুত আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে এই টিকা সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে রাখা দরকার।

পরীক্ষায় যা মিলল

জুলাইতে করোনাভাইরাসের টিকার চূড়ান্ত ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা শেষ ধাপ শুরু করে ফাইজার-বায়োএনটেক। এই পর্যায়ে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া স্বেচ্ছাসেবকদের অর্ধেকের শরীরে আসল টিকা আর বাকিদের শুধু লবণপানির প্লাসেবো প্রয়োগ করা হয়। পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৪৪ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর মধ্যে ৯৪ জন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ছিলেন। এদের মধ্যে কতজন টিকা আর কতজন প্লাসেবো পেয়েছিলেন, তা নজরে রেখেছিল বিশেষজ্ঞদের স্বাধীন একটি প্যানেল। চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে টিকাটি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ৯০ ভাগ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়। কিন্তু ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নীতি মেনে পরীক্ষার তথ্যটি পরিষ্কার করা হয়নি। অর্থাৎ, আক্রান্ত ৯৪ জনের কতজনকে টিকা আর কতজনকে প্লাসেবো দেওয়া হয়েছিল তা শুধু জানত ওই স্বাধীন বিশেষজ্ঞ প্যানেলই। স্বেচ্ছাসেবক, চিকিৎসক এমনকি দুই কোম্পানির শীর্ষ কর্তারাও ছিলেন অন্ধকারে। তবে টিকাটি ৯০ ভাগ কার্যকর বলে যে দাবি করা হয়েছে, তাতে একটা বিষয় পরিষ্কার, যারা টিকাটি পেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে থেকে খুব কমজনই কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছিলেন।    

আসলেই কি ভালো ফলাফল?

টিকা প্রস্তুতকারীদের জরুরি অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে টিকা ৫০ ভাগ কার্যকার হবে, এমন একটি বাধ্যবাধকতা ঠিক করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ কর্তৃপক্ষ-এফডিএ। ফাইজার-বায়োএনটেকের প্রাথমিক তথ্যটি যদি ঠিক হয় এবং মাঠপর্যায়ের প্রয়োগে এর সঠিক প্রতিফলন ঘটে, তাহলে তা নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে বেশিই সুরক্ষা দেবে। বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত টিকাগুলোর মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা ৪০-৬০% কার্যকর হয়। কারণ এই ভাইরাসটি বছরের পর বছর ধরে রূপ বদলায়। অন্যদিকে হামের দুই ডোজ টিকার কার্যকারিতা ৯৭ ভাগ।

নিরাপদ হবে তো?

গত মে থেকে চালানো ছোট আকারে কয়েক ধাপের পরীক্ষা আর চলমান চূড়ান্ত ধাপ- কোনো পর্যায়েই টিকা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। ফাইজার-বায়োএনটেক মূলত চার ধরনের টিকা আনার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে শুধু একটির প্রয়োগে জ্বর এবং অবসাদের মতো মৃদু উপসর্গ দেখা গিয়েছিল। তাছাড়া জরুরি অনুমোদন ও লাখ লাখ মানুষকে প্রয়োগের সময় ন্যূনতম ঝুঁকিও যাতে না থাকে, সেজন্য পুরো বিষয়টির ওপর নজর রাখবে এফডিএ এবং সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন। ট্রায়ালে যারা অংশ নিয়েছেন তাদেরকেও আরও ‍দুই বছর নজরদারিতে রাখা হবে।

প্রথম কারা পাবে টিকা?

ফাইজারের প্রধান নির্বাহী বলেছেন, বছর শেষ হওয়ার আগেই তারা তিন থেকে চার কোটি টিকা আনতে পারবেন। প্রাথমিক ডোজ এবং তিন সপ্তাহ পর বুস্টারসহ দেড় থেকে দুই কোটি মানুষের জন্য যা যথেষ্ট। কারা প্রথম ধাপে টিকা পাবে, তা এখনও ঠিক হয়নি। তবে যারা সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছে, তাদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মী, বয়স্ক এবং যাদের ডায়াবেটিস, স্থুলতার মতো সমস্যা রয়েছে, তারা থাকতে পারেন।

সাধারণ মানুষ পাবে কবে?

ফাইজার জানিয়েছে, এফডিএর চাহিদামাফিক টিকার দুই মাসের নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য সংগ্রহের পর নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে তারা এটি প্রয়োগের জন্য জরুরি অনুমোদন চাইতে পারে। এরপর বিশেষজ্ঞদের বাইরের পরামর্শকদের সঙ্গে এফডিএর আলোচনা এবং টিকার নিরাপত্তা, কার্যকারিতা ও লাখ লাখ নিরাপদ ডোজ উৎপাদনে কোম্পানিগুলোর সক্ষমতার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। সবমিলিয়ে এ বছরের শেষ নাগাদ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠির জন্য টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হতে পারে, কিন্তু সবকিছুই নির্ভর করছে যদি সবকিছু পরিকল্পনা মতো চলে আর অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্ব না ঘটে।

কতটা পথ বাকি?

কোভিড-১৯ সংক্রমণের ১৬৪টি কেইস না পাওয়া পর্যন্ত চলবে চূড়ান্ত ধাপের ট্রায়াল। এরপরই টিকার পরীক্ষা শেষ হবে এবং ফলাফল বিশ্লেষণ করা হবে।

বয়স্কদের ওপর কার্যকর হবে?

ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা করোনাভাইরাস থেকে বয়স্কদের কতটা সুরক্ষা দেবে তা নতুন তথ্যে পরিষ্কার নয়। তবে যেহেতু ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ৬৫ বছরের বেশি বয়সীরাও অংশ নিয়েছেন, তাতে করে এই বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলতে পারে।

শিশুদের কি হবে?

শিশুদের ওপর টিকা কার্যকার হবে কিনা তা নিয়েও অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমদিকে এই টিকার ট্রায়াল ১৮ থেকে তার বেশি বয়সীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। তবে আশার কথা হল, সেপ্টেম্বরে তারা ১৬ বছর বয়সীদের ট্রায়ালে অন্তর্ভুক্ত করে। আর গত মাসে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের নিয়েও কাজ শুরু করেছে।

অপারেশন র‌্যাপ স্পিডে আছে ফাইজার?

ফাইজার জুলাইতে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অপারেশন র‌্যাপ স্পিডের সঙ্গে । কয়েকটি কোম্পানির মাধ্যমে করোনাভাইরাসের ১০ কোটি ডোজ টিকা বাজারে আনতে এই উদ্যোগ নিয়েছে দেশটির সরকার। এটি হল টিকার অগ্রিম ক্রয়াদেশ চুক্তি। এর অর্থ হল- কোনো কোম্পানি টিকা সরবরাহ না করলে অর্থও পাবে না। ডনাল্ড ট্রাম্প এবং অপারেশন র‌্যাপ স্পিড থেকে দূরেই ছিল ফাইজার। কিন্তু গত রোববার ক্ম্পোনির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং হেড অব ভ্যাকসিন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট ক্যাথরিন জ্যানসেন বলেন, “আমরা কখনই র‌্যাপ স্পিডের অংশ ছিলাম না। আমরা সরকারের কাছ থেকে কিংবা অন্য কারও কাছ থেকেও অর্থ নিইনি।” আর সোমবার ফাইজারের একজন মুখপাত্র বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে বলেন, তাদের কোম্পানিও অপারেশন র‌্যাপ স্পিডের সঙ্গে আছে।

দৌড়ে থাকা অন্য টিকাগুলোর কি অবস্থা?

বর্তমানে বিভিন্ন দেশে ১০টি টিকার চূড়ান্ত ধাপের ট্রায়াল চলছে। ফাইজার-বায়োএনটেকের সফলতার খবরে কিছুটা হতাশ হতে পারে টিকা তৈরির দৌড়ে থাকা অন্য কোম্পানিগুলো। ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা প্রয়োগে মানুষের শরীরে এক ধরনের ভাইরাল প্রোটিন তৈরি হবে, যাকে বলা হচ্ছে স্পাইক। অন্যদিকে বেশকিছু টিকার মাধ্যমে শরীরে স্পাইক প্রোটিন বা তার একটি অংশ সরবরাহ করা হয়, যাতে শরীরের ইমিউন সিস্টেম সেটিকে শনাক্ত করতে পারে। এখন যদি স্পাইক প্রোটিন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে শক্তভাবে কার্যকর প্রাণিত হয়, তাহলে সামনের দিনগুলোতে অন্য টিকাগুলোর বিষয়েও আশাজাগানিয়া খবর মিলতে পারে।

তাহলে কি মাস্ক ব্যবহার করব না?

কয়েক মাসের মধ্যেও যদি ফাইজারের টিকা ব্যবহারের অনুমোদন মেলে, তারপরও তা শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষই পাবে ধরে নেওয়া যায়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সবার জন্য কার্যকর একটি টিকা মিলতে পারে আগামী বছর। তাছাড়া কোনো টিকা ভাইরাসটির লক্ষণবিহীন সংক্রমণ রোধ কিংবা মানুষকে মারাত্মক কেভিড-১৯ থেকে সুরক্ষা দিতে পারবে কিনা, তার কোনো তথ্য এখনও মেলেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা সহজলভ্য হলেও জনস্বাস্থ্যের ওপর থেকে হুমকি না কমা পর্যন্ত মাস্কের ব্যবহার চালিয়ে যেতে হবে।


Source: bdnews24.com
Thanks for using MedEx!
How would you rate your experience so far?