প্রস্তাবিত ওষুধ ও কসমেটিকস আইন কোনো সুফল বয়ে আনবে কি?
14 Aug, 2023
দীর্ঘ একচল্লিশ বছর পর ওষুধ এবং প্রথমবারের মতো কসমেটিকস নিয়ে একটি যুগোপযোগী আইন প্রণীত হতে যাচ্ছে। ৬ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভা ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে এবং ৬ এপ্রিল আইনটি বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হওয়ার পর সংসদীয় কমিটিতে পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হয়েছে। দেশে ওষুধ উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ, বিতরণ, আমদানি, রপ্তানি, মজুত, সংরক্ষণ, প্রদর্শন, বিক্রয়, মূল্য নির্ধারণ প্রভৃতি বিষয় নিয়ন্ত্রণের জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এতদিন ভরসা ছিল ব্রিটিশ আমলে জারি করা ড্রাগস অ্যাক্ট ১৯৪০ ও ১৯৮২ সালের ড্রাগস অর্ডিন্যান্স। এ দুটি আইন বিশেষ করে ড্রাগস অর্ডিন্যান্স ১৯৮২-এর কল্যাণে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। ওষুধের বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন থাকলেও এতদিন কসমেটিকসের জন্য আইন ছিল না। প্রস্তাবিত আইনে ওষুধের পাশাপাশি কসমেটিকস অন্তর্ভুক্তিকরণ একটি বড় ধরনের চমক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
বর্তমানে বাংলাদেশে ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ পূরণ করে বিশ্বের ১৫৭টি দেশে ৪৬টি কোম্পানির ৩০০ ধরনের ওষুধ ও মেডিকেল পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধ রপ্তানি করে আয় করেছে ৬,৫৭৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশ থেকে এখন ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকাতে। ওষুধের চেয়ে দেশের প্রসাধনী ও পারসোনাল কেয়ার পণ্যের বাজার প্রায় দিগুণ (২৫ হাজার কোটি টাকা)। প্রসাধনী ও পারসোনাল কেয়ার পণ্যের ৩৫ শতাংশ দেশে তৈরি হয় এবং বাকি ৬৫ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের ওষুধের বাজার এ রকম ছিল না। সেসময় অভ্যন্তরীণ চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ ওষুধ দেশে উৎপাদিত হতো। বাকি প্রায় ৮০ শতাংশ ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। দেশের অভ্যন্তরে যে ওষুধ উৎপাদিত হতো তার আবার সিংহভাগ উৎপাদন করত কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি। ১৯৮১ সালের আগ পর্যন্ত এ অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। সে সময়ও প্রায় ৭০ শতাংশ ওষুধ আমদানি করতে হতো। তাই জীবনরক্ষাকারী ওষুধ দুষ্প্রাপ্য ছিল এবং দাম ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
১৯৮২ সালে তৎকালীন সরকার কর্তৃক প্রণীত ড্রাগস অর্ডিন্যান্স এ অবস্থার পরিবর্তন আনে। এই ড্রাগস অর্ডিন্যান্সের কল্যাণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্যের অবসান ঘটে; ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ায় ওষুধের দাম নাগালের মধ্যে আসে, স্থানীয় কোম্পানিগুলো বিকশিত হয়, অনেক বহুজাতিক কোম্পানি শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে দেশীয় মালিকানাধীন কোম্পানিতে পরিণত হয়, বেশকিছু অপ্রয়োজনীয় ওষুধের উৎপাদন ও কাঁচামাল আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়, সব কোম্পানিতে কমপক্ষে একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগের বাধ্যবাধকতা থাকায় মানসম্পন্ন ওষুধের উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা সহজ হয়। একটি সময়োপযোগী আইন যে একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকে আমদানিনির্ভরতা থেকে স্বনির্ভর ও রপ্তানিসক্ষম শিল্পে রূপান্তর করতে পারে, ড্রাগস অর্ডিন্যান্স ১৯৮২ এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
অনুমোদিত ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এর বিশেষ দিক হলো কসমেটিকস-এর উৎপাদন, বিতরণ, আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণকল্পে একটি অধ্যায় সংযোজন। তবে ১৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে ওষুধ আইন থেকে কসমেটিকসকে বাদ দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা। ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা এ আইনে কসমেটিকস অন্তর্ভুক্ত করায় কসমেটিক ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কসমেটিকসের দাম বাড়বে। তারা এ-ও আশঙ্কা করছেন যে, ওষুধের সঙ্গে কসমেটিকস যুক্ত করার ফলে বিষয়টি জটিল রূপ নেবে। তাই তারা পৃথক কসমেটিক আইন করার কথা বলছেন। অন্যদিকে, বিএসটিআই বলেছে, আইনটি বাস্তবায়ন হলে কসমেটিকসের উৎপাদন, বিতরণ, আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ঔষধ প্রশাসনের হাতে চলে যাবে; ফলে বিএসটিআইয়ের এতদিন কসমেটিকস পণ্যের ওপর যে নিয়ন্ত্রণ ছিল তা খর্ব হবে।
বিএসটিআই কসমেটিকসের উৎপাদন, বিতরণ, আমদানি-রপ্তানি, মূল্য নির্ধারণ এবং ভেজাল ও নকল পণ্য বাজারজাত বন্ধে সফল হতে পারেনি। এর সম্ভাব্য কারণ বিএসটিআই-এর ব্যাপক কার্যপরিধি। ওষুধ ব্যতীত খাদ্য থেকে শুরু করে প্রায় সব শিল্পপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের ভার শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন এ প্রতিষ্ঠানটির। তাই সম্ভবত কসমেটিকসের মতো মানবস্বাস্থ্যের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, নকল ও ভেজাল কসমেটিকসে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। নকল ও ভেজাল কসমেটিকস ব্যবহার করে মানুষ ক্যানসারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ৬ এপ্রিল কসমেটিকস পণ্য আমদানিকারক, বাজারজাতকারী ও ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণে এক মতবিনিময় সভায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, কসমেটিকসের বাজারে নকল, ভেজাল ও কাস্টমস ফাঁকি দিয়ে আসা পণ্য দিয়ে ব্যাপকভাবে ছেয়ে গেছে এবং এদের কারণে যারা বৈধ পথে আমদানি করছেন বা উৎপাদন করছেন, তারা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারছেন না।
তাছাড়া এটিও লক্ষণীয় যে, অনেক সম্ভাবনা ও দক্ষ জনশক্তি থাকার পরও কসমেটিকস রপ্তানি এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। তবে ধীরে ধীরে কসমেটিকসের রপ্তানি বাজার বাড়ছে। মধ্যপ্রাচসহ বেশ কয়েকটি দেশে রপ্তানি হচ্ছে দেশে উৎপাদিত কসমেটিকস। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের একটি বড় অংশ এখনো বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। স্পেনের ‘কান্ডার ওয়ার্ল্ড প্যানেল’ নামক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সেরা দশটি প্রসাধনীর নয়টি ছিল দেশে অবস্থিত বহুজাতিক কোম্পানি। তাই কসমেটিকসের উৎপাদন, বিতরণ, আমদানি-রপ্তানি, বিদেশি প্রসাধনী কোম্পানি যেমন ইউনিলিভারের আধিপত্য ইত্যাদি অবস্থার সঙ্গে ড্রাগস অর্ডিন্যান্স ১৯৮২ প্রবর্তনের পূর্বের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা যায়। কসমেটিকসের বর্তমান বাজারকে নকল ও ভেজালমুক্ত রাখতে, বিদেশ থেকে কসমেটিকস আমদানি নিরুৎসাহিত করতে এবং দেশীয় কোম্পানিগুলোর বিকাশ ঘটিয়ে উন্নতমানের পণ্য তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধি করতে প্রণীত ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এ কসমেটিকসসংক্রান্ত বিধিবিধান সংযোজন অত্যন্ত সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ বলে মনে করি। তবে কসমেটিকস আইনের মাধ্যমে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তারা যাতে তাদের উদ্ভাবিত ও উৎপাদিত পণ্য নিবন্ধন, উৎপাদন, বিক্রয় এবং রপ্তানি করতে অসুবিধার মধ্যে না পড়েন সেদিকে খেয়াল রাখা বাঞ্ছনীয়। তা না হলে কসমেটিকস ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য।
প্রণীত ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো ফার্মাসিস্টের পরিচয় নির্দিষ্ট করে দেওয়া। আইনে ফার্মাসিস্টের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে ‘ফার্মাসিস্ট’ হলো বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের ‘এ’ ক্যাটাগরিতে নিবন্ধিত ফার্মাসিস্ট। নতুন আইনে ফার্মেসি কাউন্সিলের ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরিতে নিবন্ধিত ব্যক্তিরা যথাক্রমে ‘ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট’ ও ‘ফার্মেসি টেকনিশিয়ান’ নামে পরিচিত হবেন। ফলে গ্র্যাজুয়েট বা ‘এ’ ক্যাটাগরিতে নিবন্ধিত ফার্মাসিস্ট ব্যতীত আর কেউ সরাসরি ‘ফার্মাসিস্ট’ পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না। এ আইনের ফলে ‘ফার্মাসিস্ট’ পরিচয় নিয়ে দীর্ঘদিনের বিভ্রান্তির অবসান হলো। প্রসঙ্গত, ফার্মেসি অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এ ফার্মেসিতে স্নাতকধারী গ্র্যাজুয়েটরা, ফার্মেসিতে ডিপ্লোমা পাশ করা ব্যক্তিরা ও তিন মাসের ফার্মেসি সার্টিফিকেট কোর্স সম্পন্নকারী ব্যক্তিদের যথাক্রমে এ-গ্রেড, বি-গ্রেড ও সি-গ্রেড ফার্মাসিস্ট বলার বিধান ছিল।
ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হলো ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, ফার্মাকোভিজিল্যান্স ও ভ্যাকসিনের নতুন লট রিলিজ নিয়ে একটি নতুন অধ্যায়ের সংযুক্তি। এ অধ্যায়ে ওষুধ, ভ্যাকসিন ও মেডিকেল ডিভাইসের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, ফিল্ড ট্রায়াল, বায়োইকুইভ্যালেন্স টেস্ট করার জন্য কন্ট্রাক্ট রিসার্চ অর্গানাইজেশন (সিআরও) পরিচালনা করার অনুমতি প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এর ফলে ওষুধ রপ্তানির জন্য অন্যতম শর্ত ‘বায়োইকুইভ্যালেন্স টেস্ট’ করার পথ সুগম হবে। পাশাপাশি দেশে ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনা সহজ হবে এবং ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারী স্বেচ্ছাসেবকদের অধিকার ও নিরাপত্তা সংরক্ষিত হবে। এ আইনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হলো ইউনানি চিকিৎসক, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট, ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট অথবা ফার্মেসি টেকনিশিয়ানের তত্ত্বাবধান ছাড়া ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ওষুধ বিক্রি করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাছাড়া হোমিওপ্যাথিক ও বায়োকেমিক অ্যালোপেথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিক, বায়োকেমিক ওষুধ বিক্রয় বা বিতরণের জন্য ফুটপাত, পার্ক, গণপরিবহণ বা অন্য কোনো বাহনে ফেরি করে ওষুধ বিক্রয় করাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত ওষুধ ও কসমেটিকস আইনে ওষুধ সম্পর্কিত বেশকিছু ধারা সংযোজিত হলেও হাসপাতালে ওষুধের সঠিক ও যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ও হাসপাতালে ওষুধের ক্রয়, ডিস্পেন্সিংসহ সার্বিক বিষয় তত্ত্বাবধানের জন্য ‘হসপিটাল ফার্মাসিস্ট’ নিয়োগের কথা বলা হয়নি। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, একটি ৫০ শয্যার হাসপাতালে কমপক্ষে তিনজন, ১০০ শয্যার হাসপাতালে কমপক্ষে পাঁচজন, ২০০ শয্যার হাসপাতালে কমপক্ষে আটজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট থাকার বিধান রয়েছে। নতুন আইনে ওষুধের সঠিক ও যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে এবং হাসপাতালে ওষুধের ক্রয়, ডিস্পেন্সিংসহ সার্বিক বিষয় তত্ত্বাবধানের জন্য সব হাসপাতালে এ-গ্রেড ফার্মাসিস্ট নিয়োগের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। একসময় দেশে পর্যাপ্ত গ্র্যাজুয়েট ফার্মসিস্ট ছিল না, কিন্তু এখন প্রতিবছর এক হাজারের বেশি গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হচ্ছে। তাই দেশের স্বাস্থ্যসেবায় ফার্মাসিস্টদের অংশগ্রহণ এখন সময়ের দাবি। স্বাস্থ্যসেবায় ফার্মাসিস্টদের অংশগ্রহণ ব্যতীত পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া অসম্ভব। আইনটি যেহেতু এখন সংসদীয় কমিটিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, তাই, সরকার চাইলে সব হাসপাতালে এ-গ্রেড ফার্মাসিস্ট (গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট) নিয়োগের জন্য একটি অধ্যায় সংযুক্ত করা অসম্ভব নয়। পাশাপাশি ওষুধ থেকে কসমেটিকস আলাদা করে একটি আলাদা কসমেটিকস আইন প্রণয়নের যে দাবি ব্যবসায়ী নেতারা তুলেছেন, তা-ও বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এতে যাতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি না হয় এবং যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩ প্রণীত হতে যাছে, তা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়।
ড. মো. আজিজুর রহমান,
অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ ও সাবেক প্রশাসক,
জনসংযোগ দপ্তর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Source: jugantor.com
বর্তমানে বাংলাদেশে ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ পূরণ করে বিশ্বের ১৫৭টি দেশে ৪৬টি কোম্পানির ৩০০ ধরনের ওষুধ ও মেডিকেল পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধ রপ্তানি করে আয় করেছে ৬,৫৭৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশ থেকে এখন ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকাতে। ওষুধের চেয়ে দেশের প্রসাধনী ও পারসোনাল কেয়ার পণ্যের বাজার প্রায় দিগুণ (২৫ হাজার কোটি টাকা)। প্রসাধনী ও পারসোনাল কেয়ার পণ্যের ৩৫ শতাংশ দেশে তৈরি হয় এবং বাকি ৬৫ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের ওষুধের বাজার এ রকম ছিল না। সেসময় অভ্যন্তরীণ চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ ওষুধ দেশে উৎপাদিত হতো। বাকি প্রায় ৮০ শতাংশ ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। দেশের অভ্যন্তরে যে ওষুধ উৎপাদিত হতো তার আবার সিংহভাগ উৎপাদন করত কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি। ১৯৮১ সালের আগ পর্যন্ত এ অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। সে সময়ও প্রায় ৭০ শতাংশ ওষুধ আমদানি করতে হতো। তাই জীবনরক্ষাকারী ওষুধ দুষ্প্রাপ্য ছিল এবং দাম ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
১৯৮২ সালে তৎকালীন সরকার কর্তৃক প্রণীত ড্রাগস অর্ডিন্যান্স এ অবস্থার পরিবর্তন আনে। এই ড্রাগস অর্ডিন্যান্সের কল্যাণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্যের অবসান ঘটে; ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ায় ওষুধের দাম নাগালের মধ্যে আসে, স্থানীয় কোম্পানিগুলো বিকশিত হয়, অনেক বহুজাতিক কোম্পানি শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে দেশীয় মালিকানাধীন কোম্পানিতে পরিণত হয়, বেশকিছু অপ্রয়োজনীয় ওষুধের উৎপাদন ও কাঁচামাল আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়, সব কোম্পানিতে কমপক্ষে একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগের বাধ্যবাধকতা থাকায় মানসম্পন্ন ওষুধের উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা সহজ হয়। একটি সময়োপযোগী আইন যে একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকে আমদানিনির্ভরতা থেকে স্বনির্ভর ও রপ্তানিসক্ষম শিল্পে রূপান্তর করতে পারে, ড্রাগস অর্ডিন্যান্স ১৯৮২ এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
অনুমোদিত ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এর বিশেষ দিক হলো কসমেটিকস-এর উৎপাদন, বিতরণ, আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণকল্পে একটি অধ্যায় সংযোজন। তবে ১৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে ওষুধ আইন থেকে কসমেটিকসকে বাদ দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা। ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা এ আইনে কসমেটিকস অন্তর্ভুক্ত করায় কসমেটিক ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কসমেটিকসের দাম বাড়বে। তারা এ-ও আশঙ্কা করছেন যে, ওষুধের সঙ্গে কসমেটিকস যুক্ত করার ফলে বিষয়টি জটিল রূপ নেবে। তাই তারা পৃথক কসমেটিক আইন করার কথা বলছেন। অন্যদিকে, বিএসটিআই বলেছে, আইনটি বাস্তবায়ন হলে কসমেটিকসের উৎপাদন, বিতরণ, আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ঔষধ প্রশাসনের হাতে চলে যাবে; ফলে বিএসটিআইয়ের এতদিন কসমেটিকস পণ্যের ওপর যে নিয়ন্ত্রণ ছিল তা খর্ব হবে।
বিএসটিআই কসমেটিকসের উৎপাদন, বিতরণ, আমদানি-রপ্তানি, মূল্য নির্ধারণ এবং ভেজাল ও নকল পণ্য বাজারজাত বন্ধে সফল হতে পারেনি। এর সম্ভাব্য কারণ বিএসটিআই-এর ব্যাপক কার্যপরিধি। ওষুধ ব্যতীত খাদ্য থেকে শুরু করে প্রায় সব শিল্পপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের ভার শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন এ প্রতিষ্ঠানটির। তাই সম্ভবত কসমেটিকসের মতো মানবস্বাস্থ্যের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, নকল ও ভেজাল কসমেটিকসে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। নকল ও ভেজাল কসমেটিকস ব্যবহার করে মানুষ ক্যানসারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ৬ এপ্রিল কসমেটিকস পণ্য আমদানিকারক, বাজারজাতকারী ও ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণে এক মতবিনিময় সভায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, কসমেটিকসের বাজারে নকল, ভেজাল ও কাস্টমস ফাঁকি দিয়ে আসা পণ্য দিয়ে ব্যাপকভাবে ছেয়ে গেছে এবং এদের কারণে যারা বৈধ পথে আমদানি করছেন বা উৎপাদন করছেন, তারা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারছেন না।
তাছাড়া এটিও লক্ষণীয় যে, অনেক সম্ভাবনা ও দক্ষ জনশক্তি থাকার পরও কসমেটিকস রপ্তানি এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। তবে ধীরে ধীরে কসমেটিকসের রপ্তানি বাজার বাড়ছে। মধ্যপ্রাচসহ বেশ কয়েকটি দেশে রপ্তানি হচ্ছে দেশে উৎপাদিত কসমেটিকস। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের একটি বড় অংশ এখনো বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। স্পেনের ‘কান্ডার ওয়ার্ল্ড প্যানেল’ নামক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সেরা দশটি প্রসাধনীর নয়টি ছিল দেশে অবস্থিত বহুজাতিক কোম্পানি। তাই কসমেটিকসের উৎপাদন, বিতরণ, আমদানি-রপ্তানি, বিদেশি প্রসাধনী কোম্পানি যেমন ইউনিলিভারের আধিপত্য ইত্যাদি অবস্থার সঙ্গে ড্রাগস অর্ডিন্যান্স ১৯৮২ প্রবর্তনের পূর্বের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা যায়। কসমেটিকসের বর্তমান বাজারকে নকল ও ভেজালমুক্ত রাখতে, বিদেশ থেকে কসমেটিকস আমদানি নিরুৎসাহিত করতে এবং দেশীয় কোম্পানিগুলোর বিকাশ ঘটিয়ে উন্নতমানের পণ্য তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধি করতে প্রণীত ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এ কসমেটিকসসংক্রান্ত বিধিবিধান সংযোজন অত্যন্ত সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ বলে মনে করি। তবে কসমেটিকস আইনের মাধ্যমে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তারা যাতে তাদের উদ্ভাবিত ও উৎপাদিত পণ্য নিবন্ধন, উৎপাদন, বিক্রয় এবং রপ্তানি করতে অসুবিধার মধ্যে না পড়েন সেদিকে খেয়াল রাখা বাঞ্ছনীয়। তা না হলে কসমেটিকস ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য।
প্রণীত ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো ফার্মাসিস্টের পরিচয় নির্দিষ্ট করে দেওয়া। আইনে ফার্মাসিস্টের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে ‘ফার্মাসিস্ট’ হলো বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের ‘এ’ ক্যাটাগরিতে নিবন্ধিত ফার্মাসিস্ট। নতুন আইনে ফার্মেসি কাউন্সিলের ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরিতে নিবন্ধিত ব্যক্তিরা যথাক্রমে ‘ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট’ ও ‘ফার্মেসি টেকনিশিয়ান’ নামে পরিচিত হবেন। ফলে গ্র্যাজুয়েট বা ‘এ’ ক্যাটাগরিতে নিবন্ধিত ফার্মাসিস্ট ব্যতীত আর কেউ সরাসরি ‘ফার্মাসিস্ট’ পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না। এ আইনের ফলে ‘ফার্মাসিস্ট’ পরিচয় নিয়ে দীর্ঘদিনের বিভ্রান্তির অবসান হলো। প্রসঙ্গত, ফার্মেসি অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এ ফার্মেসিতে স্নাতকধারী গ্র্যাজুয়েটরা, ফার্মেসিতে ডিপ্লোমা পাশ করা ব্যক্তিরা ও তিন মাসের ফার্মেসি সার্টিফিকেট কোর্স সম্পন্নকারী ব্যক্তিদের যথাক্রমে এ-গ্রেড, বি-গ্রেড ও সি-গ্রেড ফার্মাসিস্ট বলার বিধান ছিল।
ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হলো ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, ফার্মাকোভিজিল্যান্স ও ভ্যাকসিনের নতুন লট রিলিজ নিয়ে একটি নতুন অধ্যায়ের সংযুক্তি। এ অধ্যায়ে ওষুধ, ভ্যাকসিন ও মেডিকেল ডিভাইসের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, ফিল্ড ট্রায়াল, বায়োইকুইভ্যালেন্স টেস্ট করার জন্য কন্ট্রাক্ট রিসার্চ অর্গানাইজেশন (সিআরও) পরিচালনা করার অনুমতি প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এর ফলে ওষুধ রপ্তানির জন্য অন্যতম শর্ত ‘বায়োইকুইভ্যালেন্স টেস্ট’ করার পথ সুগম হবে। পাশাপাশি দেশে ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনা সহজ হবে এবং ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারী স্বেচ্ছাসেবকদের অধিকার ও নিরাপত্তা সংরক্ষিত হবে। এ আইনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হলো ইউনানি চিকিৎসক, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট, ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট অথবা ফার্মেসি টেকনিশিয়ানের তত্ত্বাবধান ছাড়া ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ওষুধ বিক্রি করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাছাড়া হোমিওপ্যাথিক ও বায়োকেমিক অ্যালোপেথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিক, বায়োকেমিক ওষুধ বিক্রয় বা বিতরণের জন্য ফুটপাত, পার্ক, গণপরিবহণ বা অন্য কোনো বাহনে ফেরি করে ওষুধ বিক্রয় করাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত ওষুধ ও কসমেটিকস আইনে ওষুধ সম্পর্কিত বেশকিছু ধারা সংযোজিত হলেও হাসপাতালে ওষুধের সঠিক ও যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ও হাসপাতালে ওষুধের ক্রয়, ডিস্পেন্সিংসহ সার্বিক বিষয় তত্ত্বাবধানের জন্য ‘হসপিটাল ফার্মাসিস্ট’ নিয়োগের কথা বলা হয়নি। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, একটি ৫০ শয্যার হাসপাতালে কমপক্ষে তিনজন, ১০০ শয্যার হাসপাতালে কমপক্ষে পাঁচজন, ২০০ শয্যার হাসপাতালে কমপক্ষে আটজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট থাকার বিধান রয়েছে। নতুন আইনে ওষুধের সঠিক ও যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে এবং হাসপাতালে ওষুধের ক্রয়, ডিস্পেন্সিংসহ সার্বিক বিষয় তত্ত্বাবধানের জন্য সব হাসপাতালে এ-গ্রেড ফার্মাসিস্ট নিয়োগের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। একসময় দেশে পর্যাপ্ত গ্র্যাজুয়েট ফার্মসিস্ট ছিল না, কিন্তু এখন প্রতিবছর এক হাজারের বেশি গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হচ্ছে। তাই দেশের স্বাস্থ্যসেবায় ফার্মাসিস্টদের অংশগ্রহণ এখন সময়ের দাবি। স্বাস্থ্যসেবায় ফার্মাসিস্টদের অংশগ্রহণ ব্যতীত পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া অসম্ভব। আইনটি যেহেতু এখন সংসদীয় কমিটিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, তাই, সরকার চাইলে সব হাসপাতালে এ-গ্রেড ফার্মাসিস্ট (গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট) নিয়োগের জন্য একটি অধ্যায় সংযুক্ত করা অসম্ভব নয়। পাশাপাশি ওষুধ থেকে কসমেটিকস আলাদা করে একটি আলাদা কসমেটিকস আইন প্রণয়নের যে দাবি ব্যবসায়ী নেতারা তুলেছেন, তা-ও বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এতে যাতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি না হয় এবং যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩ প্রণীত হতে যাছে, তা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়।
ড. মো. আজিজুর রহমান,
অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ ও সাবেক প্রশাসক,
জনসংযোগ দপ্তর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Source: jugantor.com