দেশে প্রতি লাখে ১৪৪ জনের ক্যানসার

25 Jul, 2024
দেশে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত ১১৪ জন। প্রথম জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি থেকে এই পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে ক্যানসারের প্রাদুর্ভাব বেশি।

এই পরিসংখ্যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের গবেষকদের করা জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি থেকে পাওয়া গেছে। গতকাল মঙ্গলবার বিএসএমএমইউর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ নিয়ে গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করা হয়। বিএসএমএমইউ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে দেশের শীর্ষস্থানীয় গবেষক, জনস্বাস্থ্যবিদ ও ক্যানসার–বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। তাঁরা বলেন, দেশে ক্যানসার পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ তথ্য ছিল না। বৈশ্বিক উদ্যোগ গ্লোবোক্যান প্রতিবছর বাংলাদেশের ক্যানসার পরিস্থিতি নিয়ে অনুমাননির্ভর তথ্য দেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশে ক্যানসার রেজিস্ট্রির উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

কোনো দেশে বা অঞ্চলে ক্যানসারের পরিস্থিতি জানার জন্য ক্যানসার রেজিস্ট্রি বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত গবেষণাপদ্ধতি। সাধারণত তিনভাবে পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করা হয়—রোগনির্ণয় পরীক্ষার তথ্য, হাসপাতালে আসা রোগীর তথ্য এবং জনসংখ্যাভিত্তিক তথ্য। স্বাগত বক্তব্য দেন বিএসএমএমইউর পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আতিকুল হক।
 
গবেষণা ফলাফল

অনুষ্ঠানে গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করেন গবেষক দলের প্রধান ও বিএসএমএমইউর পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. খালেকুজ্জামান। তিনি বলেন, অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আর্থিক সহায়তায় গবেষকেরা ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলার পুমদি, শাহেদল, আড়াইবাড়িয়া ও গোবিন্দপুর ইউনিয়নে ২৭ হাজার পরিবারের ১ লাখ ১৬ হাজার ৪৭৫ জনের তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তাঁদের মধ্যে ক্যানসারের রোগী ১৩৩ জন। সেই হিসাবে প্রতি লাখে ক্যানসারের রোগী ১১৪ জন। নারীর তুলনায় পুরুষের মধ্যে ক্যানসারের প্রবণতা বেশি।

গবেষকেরা হোসেনপুরে ৩৬ ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পেয়েছেন। এর মধে৵ সবচেয়ে বেশি স্তন ক্যানসার। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে ঠোঁট, মুখগহবর ও কণ্ঠনালির ক্যানসার। পুরুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে (প্রথম পাঁচটি) কণ্ঠনালি, পাকস্থলী, ঠোঁট, মুখগহবর, ফুসফুস ও খাদ্যনালির ক্যানসার। নারীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে (প্রথম পাঁচটি) স্তন, জরায়ুমুখ, ঠোঁট ও মুখগহবর, থাইরয়েড ও গর্ভাশয়ের ক্যানসার।
উপস্থাপনায় মো. খালেকুজ্জামান বলেন, ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের ক্যানসারের পাশাপাশি আরও এক বা একাধিক রোগে ভুগতে দেখা গেছে। তাঁদের মধ্যে ২৮ দশমিক ৬ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ, ১১ দশমিক ৩ শতাংশের ডায়াবেটিস, ৮ দশমিক ৩ শতাংশের হৃদ্‌রোগ, ৩ শতাংশের দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ এবং ৩ শতাংশের স্ট্রোকের ইতিহাস আছে।

ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায় এমন বিষয়ের সঙ্গে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের সম্পর্কের দিকটি গবেষণায় উঠে এসেছে। পুরুষদের মধে৵ ৭৩ শতাংশ ধূমপানে অভ্যস্ত। ৪১ শতাংশ পুরুষ ও ৬১ শতাংশ নারী সাদাপাতা, তামাক ও জর্দায় অভ্যস্ত। পাশাপাশি ৬৫ শতাংশ পুরুষ ও ৭৫ শতাংশ নারীর পান–সুপারি খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে।

অনুষ্ঠানে গবেষকেরা জানান, ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীরা মূলত ঢাকা শহরে এসেই পরীক্ষা–নিরীক্ষা করান ও চিকিৎসা নেন। রোগীদের মধে৵ প্রায় ৬০ শতাংশ প্রয়োজনীয় সমন্বিত চিকিৎসা পেয়েছিলেন। ১৩ শতাংশ রোগী পেয়েছেন শুধু কেমোথেরাপি, ২ দশমিক ৩ শতাংশ পেয়েছেন শুধু রেডিওথেরাপি এবং ১১ দশমিক ৩ শতাংশের অস্ত্রোপচার হয়েছে। কোনো চিকিৎসা পাননি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী।

নির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বিষয়ভিত্তিক পরিচালক অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, পরিস্থিতি বোঝার জন্য এবং প্রতিরোধ কর্মসূচি হাতে নেওয়ার জন্য জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি উপযুক্ত কৌশল। এতে ক্যানসারের চাপটি বোঝা যায়। এই গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ ক্যানসারের ক্ষেত্রে ১ নম্বরে আছে।

অনুষ্ঠানের মুক্ত আলোচনা পর্বে ২০ জনের বেশি গবেষক, জনস্বাস্থ্যবিদ, ক্যানসার–বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক অংশ নেন।

নির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে দেশের বিশিষ্ট ক্যানসার–বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক এম এ হাই বলেন, গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় তাঁর তত্ত্বাবধানে দেশে জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু হয়নি। ক্যানসার রেজিস্ট্রি না থাকার একটি দুঃখ তাঁর মনে দীর্ঘদিন ধরে ছিল। বর্তমানে কাজটি গুরুত্বপূর্ণ।

গবেষকদের প্রধান মো. খালেকুজ্জামান বলেন, তাঁরা এই কাজ অব্যাহত রাখবেন এবং ২০২৫ সালের মধ্যে পাঁচ লাখ মানুষকে নিবন্ধনের আওতায় আনবেন।